১৯৯৪ সালে তিনি ধানমন্ডিতে গড়ে তোলেন অ্যাঞ্জেলস বিউটি পার্লার। ২০০৯ সালে তিনি ধানমন্ডিতে নিজের নামে ‘নাহিন বিউটি স্টুডিও’। সৌন্দর্যপ্রেমীদের পছন্দের একটি পরিপূর্ণ স্টুডিও এটি।
একইসময়ে তিনি মিডিয়া জগতে পা রাখেন। টিভি নাটক, বিজ্ঞাপনের মডেলদের মেকাপের কাজ শুরু করেন তিনি।
মিডিয়া প্রবেশের ঘটনাটা বেশ অন্যরকম। তেলের বিজ্ঞাপনের জন্য প্রখ্যাত নির্মাতা সাইদুল আনাম খান টুটুল মডেল খুঁজছিলেন। নাহিনের বড় বোন শাহীনের ছিল দীঘল কালো চুল। তিনি শাহীনকে বিজ্ঞাপনে নেন আর সে সময় মেকাপ করে দেন নাহিন। এ দেখে মুগ্ধ হয়ে যান নির্মাতা ও অভিনেতা আফজাল হোসেন। তিনি নাহিনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করেন।
তার মেকআপ আর্ট নিয়ে আফজাল হোসেন বলেছিলেন, তিনি পেশাদার মেকআপম্যান নন। তিনি একজন শিল্পী। আজকে মডেল ইন্ডাস্ট্রির প্রসারের পেছনে নাহিনের মতো মেকআপ আর্টিস্টের ভূমিকা বিশাল। যে সৌন্দর্যের ধারণা তিনি তার মেকআপ ব্রাশে তুলেছেন সেটিতেই প্রভাবিত হয়েছে তরুণ প্রজন্ম।
টেলিভিশন, বিজ্ঞাপনে অবাধ বিস্তার হলেও চলচ্চিত্রে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে তার একটিই কাজ। অনুপ সিংহ পরিচালিত ‘একটি নদীর নাম’ ছবিতে অভিনেত্রী শমি কায়সারের মেকআপ করেন তিনি। সেটিও ভীষণ প্রশংসিত হয়।
নিজের মেকআপের কাজ নিয়ে নাহিন নিজেকে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করেন। বলেন, স্থান-কাল-পাত্রভেদে মেকআপ করতে পারাটাই একজন আর্টিস্টের মূল চালিকাশক্তি। বিউটি এক্সপার্ট হিসেবে ২৫ বছরপূর্তি আয়োজনে তিনি এ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেন, নাটকে মেকআপ করাতে হয় চরিত্র ও পরিবেশ অনুযায়ী। অন্যদিকে বিজ্ঞাপনে পণ্য যাই হোক মডেলের গ্ল্যামার প্রাধান্য পাবে। মঞ্চের মেকআপ হবে জমকালো, যাতে দূর থেকেও মডেলকে দেখা যায়। র্যা ম্পের মেকআপ হবে মডেলের পোশাকের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। পারলারের মেকআপ হবে গ্রাহকের ত্বকের রঙের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
নাহিনের দাবি সময় ও স্টাইলের সঙ্গে মেকআপ পাল্টাবে। লাইট, ব্রাইটের খেলা চলবে নিত্য। রিসোর্স হিসেবে তিনি ফলো করেন, চলচ্চিত্র, ফ্যাশন টিভি, ইন্টারেন্ট থেকে নেওয়া তথ্য। এভাবেই নিত্য এক্সপেরিমেন্ট করেছেন মেকআপ নিয়ে এবং সফল হয়েছেন। ৪০ বছরে এই ইন্ডাস্ট্রিতে নাহিন কাজী একটি উজ্জ্বল নাম।
মিডিয়াতে তিনি ভরসার আরেক নাম। জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন ‘সারপ্রাইজ বুক অব নাহিন কাজী’ এ এমনটাই লিখেছিলেন। তিনি বলেন, নাহিন মেকআপে আছে জানলে পুরোপুরি নিশ্চিত থাকা যায়। নাহিন একবার সাবিনা ইয়াসমিনের ৮টি গানে ৮ ধরনের মেকআপ লুক করে দিয়েছিলেন। সেটি ভীষণ প্রশংসিত হয়। সাবিনা ইয়াসমিন সেটিও তুলে ধরেন।
একই বইতে ফেরদৌসি মজুমদার লিখেছিলেন, নাহিন তার কাজ নিয়ে ভীষণ স্বচ্ছ। সে তার কাজটা জানে। কোনো জাঁকজমক করে না। যেটুকু করে বুঝেই করে। কার মুখে কী মানাবে সেটি সে ভালো জানে।
প্রয়াত অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদি নাহিনের কাজের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। তিনি বলতেন নাহিন একজন উঁচুদরের মেকআপ আর্টিস্ট ও বিউটিশিয়ান। বহুবার বহু সুন্দরীর প্রশংসা করতে গিয়ে শুনেছি আমি নই- নাহিন আপা এই সৌন্দর্যের জন্য দায়ী।
অভিনেত্রী শমি কায়সার লিখেছিলেন, নাহিন শুধু আর্টিস্ট নন আমার বন্ধু। প্যাকেজ নাটকের স্বর্ণযুগে আমার কাজের পুরোটা অংশ জুড়ে ছিলেন নাহিন। সেই সময়ের সব জনপ্রিয় অভিনেত্রীরা নাহিনকে দিয়ে মেকআপ করাতেন। নাহিন আছে জানলে আমরা সবাই খুশি হয়ে যেতাম।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী তারিন জাহান নাহিন কাজীর আপন বোন। তারিন বলেন, সব সময় আপুর হাতেই সেজেছেন তিনি এবং সাজেন। বোন শুধু তার কাছে মেকআপ আর্টিস্ট নন, তার পুরো লাইফস্টাইল গাইড বলেই দাবি করেন তিনি। পেশাগত এবং ব্যক্তিগত দুই স্থানেই নিজের বোনকে সেরার স্থানটি দিয়েছেন তারিন।
কর্মজীবনে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। শুধু দেশে নয় দেশের বাইরেও মেকআপ আর্ট নিয়ে নাহিন কাজী সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েসন অব ডাইভারসিটি আর্টস অ্যান্ড মিডিয়া থেকে বিউটি আর্টিস্ট হিসেবে সম্মাননা পান তিনি। সংগঠনটি তাদের ওয়েবসাইটে লেখে- নাহীন কাজী সম্মাননা পেলেন একটু ভিন্ন খাতে। তিনি একজন সফল বিউটিসিয়ান। তার কাজ অনেকটা অন্তরালে। টেলিভিশন বা মঞ্চের অভিনেত্রী বা গায়িকাদের সাজসজ্জায় আমরা মুগ্ধ হই, অনেক সময় অনুকরণ ও করতে চাই, সেই সব মনোমুগ্ধকর সাজ সজ্জা একজন বিউটিশিয়ানের সৃষ্টি। আধুনিক বিশ্বে সব কিছুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চলতি ফ্যাশন, ফিউসন, লাইফ স্টাইল ট্রেন্ডস, হেলথ কেয়ার, তথা পারসনাল গ্রুমিং সব কিছুই জীবনে অপরিহার্য। বিশেষ করে যারা সেলিব্রিটি বা মিডিয়ার সাথে যুক্ত। সৌন্দর্য চর্চা এবং সুন্দর থাকা তাদের প্রথম ও প্রধান শর্ত। নাহীন কাজী তার কাজের মাধ্যমে দেশের মিডিয়া জগতে এক নন্দিত শিল্পীর পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করেছেন ইতিমধ্যে।
সংসারের বিশাল ক্যানভাস
নিজের পেশা জীবনের মতো সংসারটাকেও সাজিয়েছেন সুচারু হাতে। স্বামী কাজী জসিমুল ইসলাম বাপ্পী নাহিনকে মনে করেন একটি প্রতিষ্ঠান। নাহিন বুকস অব সারপ্রাইজে এমনটাই লিখেছিলেন তিনি। তার কাছ থেকেই সাংসারিক ও পেশাদার নাহিনকে জানা যায়।
কাজী বাপ্পী বলেন, ‘১৯৮৬ সালে আমাদের দেশে মায়েরা মেয়েদেরকে তিনজন গার্ড ছাড়া বের হতে দেবে না এমন অবস্থা। সে পরিস্থিতিতে একটা গণ্ডির মধ্য থেকে বের হয়ে নিজে বিউটিশিয়ান হিসেবে কাজ করেছে এটা আমাকে বেশ আনন্দ দেয়। মানুষ আমাকে নাহিনের স্বামী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয় এটা আলাদা একটা অনূভুতি কাজ করে নিজের মধ্যে।’
তিনি আরও বলেন, ‘৮ বছর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সিংহভাগ বিজ্ঞাপনে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। নাহিন ভারতে আর্ট ফিল্মে মেকআপ আর্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছে আমার জানা নেই বাংলাদেশের আর কেউ তা করেছি কিনা। সারা বাংলাদেশে লক্ষাধিক বিউটিশিয়ান কাজ করছেন এই সময়ে। নাহিন যদি সেই ৩৫ বছর আগে সাহসটা না করতো আজ হয়তো অনেকেই সাহস করতো না। নাহিনের সবচেয়ে ভালো লাগার জায়গা হচ্ছে আমি কখনও দেখিনি ও কাউকে বলেছে আমি শিখাবো না৷ যারা আগ্রহ দেখিয়েছে তাদের শিখিয়েছে। বিনিময়ে ৫ টাকাও নেয়নি কারও কাছ থেকে। চাঁদপুরে নাহিনের এক মামী ছিলেন, তার স্বামী মারা যান। এরপর তিনি আমেরিকা যাওয়ার জন্য ডিডি পান। নাহিন তখন বলেন, ডিডি পেয়ে লাভ নেই কিছু শিখে যাও। ৩ মাস নিজের পার্লারে শেখায়। এখন সে আমেরিকায় একজন বড় বিউটিশিয়ান। এমন অসংখ্য গল্প আছে নাহিনকে নিয়ে।’
শুধু পেশাদার বিউটিশিয়ানদের পথিকৃত নন সংসারের হাল ধরতে নাহিন যোগ্যতমদের একজন। এমন তকমাই দিলেন কাজী বাপ্পী। তিনি জানান, ‘১৯৮৯ সাল থেকে আমরা বন্ধু। তারপর একসঙ্গে ব্যবসা শুরু করি আমরা। কীভাবে হারবালকে বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায়। একটা পর্যায়ে আমি সবকিছু থেকে ছিটকে যাই। আমি ব্যবসায় বড় একটা লস খাই। মানুষের জীবনে উত্থান-পতন থাকে তেমনি আমার জীবনে তখন পতন ঘটে। আমার পতনের সময়ে এসে হাতটা ধরে ও। ২০০৫ সালে একসঙ্গে জুটি বাঁধি আমরা। জানলে অবাক হবেন আমাদের বিয়ে হয় যখন তখন আমি আমার রেস্টুরেন্টের ডেকোরেশনের কাজ দেখছিলাম। আমি ওখানেই ওয়াশরুম গোসল করে রেডি হয়ে নেই। তারপর ওর খালার বাসায় ছোট করে অনুষ্ঠান করা হয়।’
তবে এত হাজার লোকের মেকআপ আর্টিস্ট নাহিন, কাজী বাপ্পীর মেকআপ করে দিয়েছেন মাত্র একবার। সেও এক মজার ঘটনা। তিনি জানান, ‘বাংলাদেশে প্রথম ইলেকট্রনিক গাড়ি আমি প্রথম বানাই৷ আমরা সেটার জন্য একটা বিজ্ঞাপন তৈরি করবো। নির্মাতা ছিলেন আফজাল হোসেন। ৩০-৪০ জন মডেল নিয়ে কাজ করছে৷ হঠাৎ করে আফজাল ভাই বললো উপরে চলো। নাহিনকে বললো এই ওরে মেকআপ দে। বলা যায় এটাই প্রথম আমাকে মেকআপ করায়।’
মানবিক নাহিন হিসেবে তিনি বলেন, মানুষকে সাহায্যকারী নাহিন। ভালো মনের মানুষ ও আমার রাগ সে সহ্য করে। নাহিনকে নিয়ে প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে যান পাশে থাকা মানুষটি। তিনি চান এতিম মেয়েদের জন্য একটা ইন্সটিটিউট করুক নাহিন। যাদেরকে পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেভাবে তৈরি করার চেষ্টা করবো। আমার অনেক বন্ধু রয়েছে যারা নিজেরা নিজেদের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। আমি তাদের সবাইকে এই উদ্যোগ সম্পর্কে জানাবো তারা সকলে যাতে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী কয়েকজনের দায়িত্ব নেয়। আমি ইতিমধ্যে দুই-তিন বিঘা জমি কেনার পরিকল্পনা করছি এই উদ্যোগটা জন্য।
এমনই অসংখ্য স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নাহিন কাজী। বাংলাদেশের রূপ বিশেষজ্ঞদের পথিকৃত নাহিন শুধু এক গণ্ডিতেই থেমে থাকেননি।
আর সব স্বপ্ন ছাপিয়ে আরেকটি যে স্বপ্ন দেখেন প্রতিনিয়ত সেটি হচ্ছে নিজের একমাত্র সন্তান জাসিন কাজীকে যোগ্য ও সুসন্তান গড়ে তোলা। মাকে নিয়ে ভীষণ গর্বিত জাসিন। মায়ের মতো কেয়ারিং আর কেউ নেই বলে দাবি ছেলের। তার মতো চমৎকার রান্নাও কেউ করতে পারেন না। একই দাবি অবশ্য কাজী বাপ্পীরও। তার দাবি আমার এই বিশাল বপুর কৃতিত্ব পুরোটাই নাহিনের। তিনিই জানালেন নাহিনের ১২টি রান্নার খাতা আছে। দেশ-বিদেশের রান্না সব টুকে রাখেন তিনি।
টারিখ: ১৮ জুন ২০২১, ১৪:১৯
প্রকাশিত: Bangla Tribune